লবন খাওয়া কমালেই কি প্রেসারের সমস্যা কমে যাবে?
খাবার লবন কম খেলে প্রেসার কন্ট্রোলে থাকে এই ধারনাটার বিপক্ষে লেইটেস্ট সায়েন্টিফিক এভিডেন্স পাওয়া গেছে। বরঞ্চ, এখন বলা হচ্ছে, প্রয়োজন অনুযায়ী লবন না খেলে আপনার ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পাবে এবং ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোল আপনার জন্য অধিকতর কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি হৃদরোগের ঝুকিও বাড়বে। আগে ভাবা হত যে সোডিয়াম ইনটেক আপনি যত বাড়াবেন, হার্ট ডিজিজ রিস্ক ততই বাড়বে। কিন্তু ২০১৬ সালে উনপঞ্চাশটা দেশের এক লাখ তেত্রিশ হাজার একশো আঠারো জন মানুষ যাদের মধ্যে ৬৫ হাজার ৫৫৯ জন হাইপারটেন্সিভ(উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত) ও ৬৯ হাজার ৫৫৯ জন নরমোটেন্সিভ(স্বাভাবিক রক্তচাপ) মানুষের ওপর চালানো এক গবেষনায় দেখা যায়, হার্ট ডিজিজের রিস্ক লবন খাওয়া বাড়া-কমার সাথে সাথেই বাড়ে কমে ব্যাপারটা এমন না। বরঞ্চ, ব্যাপারটা অনেকটা U শেইপড লুপের মত কাজ করে। একটা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম লবন খেলেও হার্ট ডিজিজের রিস্ক বাড়ে, নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি খেলেও একই পরিমান রিস্ক বাড়ে(১১%)।
ড. বেঞ্জামিন বিকম্যান এক্ষেত্রে আরো দুটো স্টাডিকে উল্লেখ করেছেন। একটা ২২৭ জনের ওপর করা হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে যারা কম লবন খান(দিনে ২৩০০ এমজির নিচে) তাদের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়তে থাকে।
১৫২ জনের ওপর করা আরেকটা স্টাডিতে সাবজেক্টদেরকে এক সপ্তাহ করে লো সল্ট ডায়েট ও হাই সল্ট ডায়েটে রেখে দেখা গেছে লো সল্টে যারা থাকেন তাদের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পায়।
৩৮৯ জনের ওপর করা আরেকটা স্টাডিতে সল্ট সেন্সিটিভ এবং সল্ট রেজিস্ট্যান্ট সাবজেক্টদের আলাদা করে এক সপ্তাহ করে লো সল্ট ও হাই সল্ট ডায়েট দেয়া হয় । সেখানেও দেখা যায়, উভয় গ্রুপেই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বেড়েছে।
এটা কিভাবে ঘটে??
সল্ট সেন্সিটিভ হচ্ছেন তারা, যাদের এক্সট্রা সল্ট(দিনে ৩ গ্রামের বেশি সোডিয়াম) বা সোডিয়াম খেলে ব্লাড প্রেসার বাড়ে, আর সল্ট রেজিস্ট্যান্ট হচ্ছেন তারা যারা বেশ খানিকটা এক্সট্রা সল্ট খেলেও সাধারনত ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোলে থাকে।
আপনার ব্লাড প্রেসার দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত কিডনির মাধ্যমে। সল্ট সেন্সিটিভ যারা, তাদের কিডনি অতিরিক্ত লবন দ্রুত ফ্ল্যাশ করতে পারে না ফলে তাদের লবন খেলেই বিপি বেড়ে যায়। কারো ক্ষেত্রে এটা জিনেটিক, কারো ক্ষেত্রে এটা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা স্ট্রেস থেকে হয়।
আবার অনেকে আছেন যাদের কিডনি দ্রুত সল্ট শরীর থেকে বের করে দিতে পারে, তারা সল্ট রেজিস্ট্যান্ট এবং তারা লবন বেশি খেলেও (দিনে ৮-১০ গ্রাম সোডিয়াম) বিপি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ে না।
ব্লাড প্রেসার কমাতে রসুনের ভূমিকা
তো যারা সল্ট সেন্সিটিভ, তাদের ক্ষেত্রেই মূলত ডায়েটে সল্ট রেস্ট্রিক্ট করা হয় সারা পৃথিবীতে। বলা হয় লবন কম খেতে। হাইপারটেনশনে ভোগা রোগীদেরকে বাই ডিফল্ট সল্ট সেন্সিটিভ বলে ধরা হয় ম্যানেজমেন্ট দেয়ার সময়।
সমস্যাটা হচ্ছে, লবন কম খেলে এই রোগীদের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যাচ্ছে রেনিন এনজিওটেনসিন এলডোস্টেরন সিস্টেম নামের একটা সিস্টেমের মাধ্যমে। ব্লাডে সোডিয়াম কমলেই এল্ডোস্টেরন বেড়ে যায় সোডিয়াম কন্সেন্ট্রেশন বাড়ানোর জন্য, আর এল্ডোস্টেরন বাড়লেই বাড়ে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
চেইন রিএকশনের মত, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থেকে আবার হাইপারটেনশান বাড়তে পারে, কিডনির আউটপুট আরো খারাপ হতে পারে, রক্তে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি হয়ে লিপিড প্রোফাইল খারাপের দিকে যেতে পারে এবং সর্বোপরি রোগী ওয়েট গেইন করতে পারে।
এত এত কথা লেখার কারন কি??
কারনটা হল, ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোল ও কার্ডিওভাস্কুলার হেলথ ইমপ্রুভমেন্টের জন্য কম লবন খাওয়াই যে সমাধান না সেটা বোঝানো।
সমাধানটা তাহলে কোথায়??
সমাধানটা এখানে লো কার্ব ডায়েট ও সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের যথেষ্ট ইনটেকে।
লো কার্ব ডায়েট ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমায়, পটাসিয়াম ও সোডিয়ামের ২ঃ১ থেকে ৪ঃ১ রেশিও বিপি পুরোপুরি স্বাভাবিক রাখে এবং ম্যাগনেসিয়াম আপনার এড্রেনাল গ্ল্যান্ড-হার্ট-ব্রেইনকে শান্ত রাখে তার এন্টি স্ট্রেস মেকানিজমের মাধ্যমে।
তাই ব্লাড প্রেসার বাড়লে খাবার থেকে লবন একেবারে বাদ না দিয়ে বরঞ্চ কার্ব ইনটেক ৫০% এর বেশি থাকলে তা কমান, লবন আপনি কতটুকু নিতে পারেন তার মাত্রা বুঝতে চেষ্টা করুন(দিনে ২ গ্রাম থেকে ১০ গ্রামের মধ্যে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম লবনের মাত্রায় স্বাভাবিক থাকেন) এবং আপনার ডায়েটে ম্যাগনেসিয়াম-পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন সবুজ শাক, কাঠবাদাম, আখরোট, পাম্পকিন সিড, সানফ্লাওয়ার সিড, শিম, ডালজাতীয় খাবার, বিট পাতা, সুইস চার্ড, ডালিম, তরমুজ ইত্যাদি খেতে পারেন। সুস্থ একজন মানুষ দিনে দেড় চামচ লবন খেলে তার জন্য সবজি খাওয়া উচিত প্রায় ৪৫০ গ্রাম যদি এনাফ পটাসিয়াম খেতে চান। পরিমানটা কিন্তু অনেক!! তাই যথেষ্ট শাকসবজি খেতে যারা চান না, অতিরিক্ত লবন তাদের খাবার অনুমতি দিতে আমি রাজি নই।
লেইটেস্ট স্টাডি অনুযায়ী বলা হচ্ছে আমেরিকান সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিনে সোডিয়াম ইনটেইকের যে লিমিট বেধে দিয়েছে(২৩০০ মিলিগ্রাম), সেটা প্রয়োজনের চেয়ে কম। ৩০০০ মিলিগ্রাম হওয়া উচিত দিনে লোয়ার লিমিট, আপার লিমিট হওয়া উচিত ৬০০০ মিলিগ্রাম।
কিন্তু শুধু সোডিয়াম ইনটেইকের পরিমান দিয়ে রক্তচাপ ও হৃদরোগকে বুঝতে যাওয়া বা আমাদের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্সকে বুঝতে যাওয়া বোকামি। সাধারন মানুষের জন্য তো বিষয়টা সম্ভবই না। তাই আমার পরামর্শ হলো, ওপরে বর্নিত বিষয় গুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন, আর নিউট্রিশনিস্ট বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো জীবন যাপন করুন।
নিউট্রিশনিস্ট মো: সজল।