গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কি এবং কেন হয়?
জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস (জিডিএম) বা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়াটা এখন খুব নিয়মিত হয়ে গিয়েছে। গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা থেকে উৎপাদিত হরমোন শরীরের ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারীতায় বাধা প্রদান করে ফলে গ্লুকোজ কোষে শোষিত হতে পারে না এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। এই অবস্থাকেই জিডিএম বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস বলা হয়।
যদিও প্রেগন্যান্সির সময়ে যে কোন মহিলাই এই ধরনের ডায়াবেটিস এর স্বীকার হতে পারেন। তবে এর জন্য কিন্তু আপনার গর্ভাবস্থার আগের লাইফস্টাইল অনেক অংশেই দায়ী। জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস হবার মূল কিছু কারনের মধ্যে রয়েছে-
১) প্রেগ্ন্যাসির আগের অতিরিক্ত ওজন।
২) ইনসুলিন রেসিস্টেন্স থাকা বা প্রি ডায়াবেটিক থাকা।
৩) পিসিওএস বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম থাকা।
৪) এর আগে প্রেগন্যান্সিতে ডায়াবেটিস থেকে থাকলে সেটা পরবর্তী প্রেগন্যান্সিতে ব্যাক করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বাচ্চার ওজন ৯ পাউন্ডস বা ৪.১ কেজির বেশি হলেও জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি থাকে।
৫) বয়স৷ গবেষণায় দেখা যায় প্রেগ্ন্যাসির সময়ে যাদের বয়স পঁচিশ এর বেশি থাকে তাদের ডায়াবেটিস হবার চান্স বেশি।
এতো গেলো প্রেগন্যান্সির আগে কোন কন্ডিশন গুলি থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে এগুলোর কোন কোন উপসর্গ না থাকলেও আপনার জিডিএম হওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারন জিডিএম শুধুমাত্র শরীরে ইনসুলিন কম থাকার জন্য হয়না বরং প্রথমেই বলেছি, প্রেগন্যান্সির সময়ে অন্যান্য যে হরমোনগুলো উৎপাদিত হয় সেগুলো ইনসুলিন কে অনেক সময় ইফেক্টিভলি কাজ করতে দেয়না। মায়ের পেটে যে ফিটাস টা বড় হতে থাকে, প্লাসেন্টা সেই ফিটাস এর জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্টস এবং পানি সরবরাহ করে যাতে ফিটাস আস্তে আস্তে বড় হয়৷ তবে খাবার সরবরাহ করা ছাড়াও প্লাসেন্টা প্রেগন্যান্সির সময়ে বিভিন্ন ধরনের হরমোন উৎপাদন করে এবং এই হরমোন গুলির মধ্যে - এস্ট্রোজেন, কর্টিসল এবং হিউম্যান প্লাসেন্টাল ল্যাকটোজেন নামে ৩ টি হরমোন রয়েছে যারা ইনসুলিন এর ইফেক্ট কে ব্লক করে দেয়। মানে ইনসুলিন কে ইফেক্টিভলি কাজ করতে দেয়না। অর্থাৎ ইনসুলিন রেসিস্টেন্স অবস্থার সৃষ্টি করে। এই অবস্থাকে বলা হয় কন্ট্রা ইনসুলিন ইফেক্ট। যেটা সাধারণত ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয়। প্রেগ্ন্যাসির সময় যত বাড়তে থাকে প্লাসেন্টা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে এবং এই হরমোন গুলির প্রোডাকশন বাড়তে থাকে যার ফলশ্রুতিতে ইনসুলিন রেসিস্টেন্স এর ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। সাধারনত আমাদের প্যানক্রিয়াস এই কন্ট্রা ইনসুলিন ইফেক্টকে ওভারকাম করার জন্য এক্সট্রা ইনসুলিন উৎপাদন করে থাকে। তবে প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে যখন মেয়েদের ওজন বেড়ে যায় তখন প্রায় সবারই অল্প বিস্তর ইনসুলিন রেসিস্টেন্স হয়ে থাকে। তখন প্যানক্রিয়াস অতিরিক্ত ইনসুলিন উৎপাদন করেও এই ইনসুলিন রেসিস্টেন্স কে ওভারকাম করতে পারে না, যার জন্য রক্তে গ্লুকোজ এর মাত্রা বেড়ে যায় এবং এই অবস্থাকে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস বা জিডিএম বলা হয়।
ইউরিক এসিড কমানোর ঘরোয়া উপায়
জিডিএম বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কেন ভয়াবহ জানেন?
-সাধারণত জিডিএম থাকলে বাচ্চা অধিক দ্রুত বড় হয়। এই অবস্থা কে বলা হয় ম্যাক্রোসোমিয়া। বাচ্চা যে নিউট্রিয়েন্ট/পুষ্টি গ্রহন করে সেটা মায়ের ব্লাড থেকে এসে থাকে। যদি মায়ের রক্তে গ্লুকোজ এর মত্রা বেশি থাকে তবে ফিটাসের প্যানক্রিয়াস বেশি ইনসুলিন উৎপাদন করে যাতে এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ সে ব্যবহার করতে পারে এবং এক্সট্রা গ্লুকোজ কে ফ্যাটে কনভার্ট করে ফেলে।মায়ের জিডিএম থাকলেও ফিটাসের প্রয়োজনীয় ইনসুলিন সে নিজেই উৎপাদন করতে পারে কিন্তু মায়ের যেহেতু জিডিএম আছে তাই মায়ের থেকে আসা অতিরিক্ত গ্লুকোজ এবং ফিটাস যে হাই ইনসুলিন উৎপাদন করে সেটা কম্বাইন্ড করে ফ্যাটের লার্জ ডিপোজিট এ কনভার্ট হয়। যার ফলে ফিটাস অল্প সময়ে অনেক বেশি বড় হয়ে যায়।
এই সব ক্ষেত্রে আর্লি সিজারিয়ান ডেলিভারি করা ছাড়া উপায় থাকে না।
- বাচ্চা আর্লি ডেলিভারি করানো হলে বাচ্চার ইমিউনিটি দূর্বল থাকে, শ্বাসকষ্ট সহ আরও অনেক সমস্যা হয়।
- বাচ্চা জন্মের সাথে সাথে তার হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে।
-এই ধরনের প্রেগন্যান্সিতে বাচ্চাদের পরবর্তী জীবনের ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-মায়েদের ক্ষেত্রে যাদের জিডিএম থাকে তাদের প্রেশার সাধারণত হাই থাকে এবং প্রিএক্লেমশিয়া(প্রেগন্যান্সির সময়ের একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা) হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-যাদের প্রেগন্যান্সির সময়ে ডায়াবেটিস থাকে পরবর্তী প্রেগন্যান্সি এবং একটু বয়স বাড়লে টাইপ টু ডায়াবেটিস হবার হার অনেক বেশি।
উপসংহার:
এত সমস্যার মধ্যে কি সমাধান নেই?? অবশ্যই আছে। ডায়েট মোডিফিকেশন আপনার জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
প্রেগন্যান্সির সময়ে কিভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করবেন সে সম্পর্কে অবশ্যই একজন নিউট্রিশনিস্ট অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
সুমাইয়া শিলা
চাইল্ড এন্ড রিপ্রোডাক্টিভ নিউট্রিশন কনসালট্যান্ট
বিএস, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।