গোশত মানে ক্ষতি আর ক্ষতি - শাক সবজি মানে শুধু উপকার?

 

গোশত মানে ক্ষতি আর ক্ষতি - শাক সবজি মানে শুধু উপকার?

গোশত মানেই ক্ষতি আর ক্ষতি, শাকসবজি মানেই উপকার আর উপকার, বিষয়টা কি এতই সরল, তা আমাদের ভেবে দেখা উচিত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটা আমাদের করা উচিত তা হচ্ছে, যারা ধুমপান করেন না, সুগার খান না, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট এবং রিফাইন্ড অয়েল খান না, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করেন এবং প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্টগুলি নেন, তাদের মধ্যে হার্ট ডিজিজের হার অন্যদের তুলনায় বেশি কিনা এবং বেশি হলে কতটা বেশি এবং কিভাবে ও কেন বেশি।

এমন একটা স্যাম্পল পপুলেশান নিয়ে এবং তার বিপরীতে আমজনতার আরেকটা স্যাম্পল নিয়ে যদি স্টাডি করা হয়, রেজাল্ট কি আসতে পারে সেটা দেখা গেলে আমরা হয়তো একটা ধারনা পেতে পারি।

প্রথমত, স্টাডিটা হতে হবে কোহর্ট স্টাডি। কেইস-কন্ট্রোল স্টাডি করলে এই স্টাডি থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়।

সৌভাগ্যক্রমে, এমন একটা কোহর্ট স্টাডি আছে।

এখানে গবেষকরা ১১ হাজার মানুষকে সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাদের ৫৭ শতাংশ সর্বভুক, মানে গোশত সবজি সবই খান, আর ৪৩ শতাংশ হচ্ছে ভেজিটেরিয়ান। উভয় গ্রুপই স্বাস্থ্যবান।

গবেষকরা দেখলেন, প্রথাগত পশ্চিমা, প্রসেসড ফুড নির্ভর ডায়েটের তুলনায় দুই গ্রুপেই মৃত্যুহার কমে অর্ধেক হয়েছে। গবেষকরা উপসংহার টানলেন, ভেজিটেরিয়ানদের জন্য কোন বাড়তি উপকারিতা নেই, পক্ষান্তরে যারা গোশত খান, তাদেরও বাড়তি কোন হৃদরোগ/ক্যান্সারের ঝুকি নেই।

আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথের আরেকটা (এএআরপি ডায়েট এন্ড হেলথ স্টাডি) গবেষনায় দেখা গেল, যারা গোশত খান তারা অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ এবং যারা যত বেশি গোশত খান তারা খুবই অসুস্থ।

কিন্তু এই স্টাডির উপসংহার টানার সময় অন্য অনেকগুলি কো ফ্যাক্টরকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। দেখা গেল, এখানে যারা গোশত খান তারা সিগারেট বেশি খান, তাদের ওজন স্টাডি শুরুর সময় থেকেই বেশি ছিল। তাদের ডেইলি ক্যালরি কনজাম্পশন স্বাভাবিকের চেয়ে ৮০০ ক্যালরি বেশি ছিল গড়ে। তারা ব্যায়াম করতেন না এবং চিনিও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খেতেন। তাদের অনেকেরই মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। তাদের প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্ট নেয়ার অভ্যাস ছিল কম।

এই বিষয়গুলি কিন্তু পত্রিকার হেডলাইনে আসে না৷ হেডলাইনে আসে, যারা গোশত বেশি খায়, তারা অসুস্থ বেশি হয়, বা তাদের হৃদরোগের ঝুকি বাড়ে, ক্যান্সারের হার বাড়ে।

সব মিলিয়ে দিনশেষে দোষ হয় গোশতের।

আবার, বেশিরভাগ গোশত সংক্রান্ত স্টাডিতে যে গোশতগুলি মানুষ খান সেগুলি হচ্ছে ফ্যাক্টরি ফার্মড মিট, যেটাকে শর্টকাটে বলে ক্যাফো, কনফাইন্ড এনিম্যাল ফিডিং অপারেশান্স। ইন্ডাস্ট্রিয়ালি রেইজড গরুকে স্টেরয়েডস, ইউরিয়া, এন্টিবায়োটিক, পেস্টিসাইডস সবই একটা তথাকথিত "নন হার্মফুল" মাত্রায় খাওয়ানো হয় এবং এদের দ্রুত মোটা করতে খাওয়ানো হয় প্রচুর ভুট্টা, গম ও সয়াবিন। এই ভুট্টা, গম ও সয়াবিন আবার থাকে জিনেটিক্যালি মোডিফাইড। দেখা যায়, বেশিরভাগ স্টাডিই এই ক্যাফো মিট খাওয়া লোকেদের নিয়ে হয়, গ্রাস ফেড মিট বা অন্তত হরমোন-এন্টিবায়োটিক মুক্ত প্যাস্টর রেইজড/ফ্রি রেঞ্জ মিট খাওয়া মানুষদের নিয়ে কিন্তু স্টাডিগুলি করা হয় না।

ফ্রিজে দীর্ঘদিন খাবার ভালো রাখার উপায় গুলো জেনে নিন

তো এসব স্টাডি থেকে আর কি ফলাফল আশা করা সম্ভব??

সবচেয়ে বড় যে ফাকি পত্রপত্রিকাগুলি আমাদেরকে দেয় তা হচ্ছে, কোন কিছুতে ঝুকির হার আদতে কত তার ব্যাপারে ভুল ধারনা দেয়া। রিলেটিভ রিস্ক আর এবসলিউট রিস্ক বলে দুইটা ব্যাপার আছে।

ধরা যাক, রেড মিট খাওয়া ২ লাখ মানুষের ভেতর ৪০০ জন মারা গেলেন হার্ট ডিজিজ ও ক্যান্সারে। ০.২% মৃত্যুহার।

রেড মিট খান না, এমন জনগোষ্ঠীতে ২ লাখে হার্ট ডিজিজ ও ক্যান্সারে ৩০০ জন মানুষ মারা গেলেন। মৃত্যুহার ০.১৫%। মৃত্যুহার আদতে বেড়েছে কত?? 

০.০৫%। এটা হল এবসলিউট রিস্ক।

এখন আমরা যদি রিলেটিভ রিস্ক বের করতে যাই, তাহলে ০.২০ কে ০.০১৫ দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুন করবো। হয়ে যাবে ১৩৩। মানে রিলেটিভ রিস্ক ৩৩%। মিডিয়াতে হইচই পড়ে যাবে, ৩৩% মৃত্যুঝুকি বাড়ে গরুর গোশত খেলে। সাথে বাকি ফাকিঝুকি তো আছেই, স্যাম্পল পপুলেশন সিলেকশন, মিট কোয়ালিটি ম্যানিপুলেশন ইত্যাদি।

আসলে ঘটনা কি?? আসলে কিন্তু মৃত্যুহার বেড়েছে .০৫%, একশো ভাগের এক ভাগের বিশ ভাগের এক ভাগ।

মিডিয়া এইটা দিয়েই আপনাকে প্যানিক এটাক দেবে, কারন তার লাগবে ভিউ। এই রিপোর্ট পড়েই বেশিরভাগ গবেষক ও হেলথ প্রফেশনাল আতকে উঠবেন। কিন্তু যারা গভীরে খুড়ে বেড়ান, তারা এত সহজে বিচলিত হন না।

 তারা আমাদের কাছে ২০% রিলেটিভ রিস্ক বেড়ে যাওয়া

এসব কারনে, ধীরে ধীরে লাল গোশত বা রেডমিট করপোরেট মিডিয়ার খবরের শিরোনাম হতে হতে পাবলিক এনিমিতে পরিনত হয়েছে, সামাজিক  আরো হবে।

একটা শক্তি এমনিতেও চায় বিশ্বব্যাপী মানুষ গবাদি পশু পালন ছেড়ে দিক। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পশুপালনকে পলিসি ইমপ্লিমেন্ট করার মাধ্যমে গত পঞ্চাশ বছর ধরে ক্রমেই সমস্যাজনক করে তোলা হয়েছে, সেই সাথে বেড়েছে জনসংখ্যা। ফলে হেলদি মিট বনাম আনহেলদি মিটের রেশিওও বেড়েছে অনেক। 

সামনে দিন আসছে, এই আনহেলদি মিটগুলিও হয়তো বাজার থেকে উধাও করে ফেলা হবে। আসবে সিনথেটিক মিটের যুগ। বিশ্বের কিছু দেশে ইতোমধ্যেই কৃষকদের গরু পালনের ওপর বিভিন্ন আইনী বাধা সৃষ্টির কাজ শুরু হয়ে গেছে যেন এক ব্যক্তি খুব বেশি গরু পালতে না পারে।

ফুড প্রোপাগান্ডা এভাবেই কাজ করে।

গ্যারি টবেস, রবার্ট লুস্টিগ এবং নিনা টেইকোলজদের লেখা পড়ুন। বুঝতে পারবেন, বিজ্ঞানের ভাজে ভাজে প্রায়ই লুকিয়ে থাকে অপরাজনীতির অশুভ থাবা।

একজন স্মার্ট রিসার্চার কোন স্টাডিকে বোঝার সময় সেটার মেথডলজিকে বোঝে, এরপর সিদ্ধান্ত নেয়, ঐ স্টাডিকে সে কতটুকু গ্রহন করবে।

আমরা গরুর গোশতকে বেনিফিট অফ ডাউট দিচ্ছি না। আমরা বলছি, যদি সমস্যা থাকে, সেই সমস্যার পরিমান কত, সেটা আইডেন্টিফাই করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করতে।

এই পোস্টের উদ্দেশ্য গরুর গোশতের ব্যাপারে অহেতুক ভীতি দূর করা। পক্ষান্তরে আপনার বাসার যে মানুষটা গ্লাসের পর গ্লাস কোক আর প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেট খান, তাকে গরুর গোশত খেতে উৎসাহিত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url