কোকাকোলা না মোজো—কোনটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

 

কোকাকোলা না মোজো—কোনটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

কোমল পানীয় আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। যে কোনো পার্টি বা উৎসবে, ঠান্ডা কোমল পানীয় ছাড়া ভাবাই যায় না। তবে, এই পানীয়গুলো শুধুই স্বাদে সীমাবদ্ধ নয়, স্বাস্থ্যগত দিকেও তাদের প্রভাব রয়েছে। আজ আমরা দুটি জনপ্রিয় কোমল পানীয় কোকাকোলা এবং মোজো - এর মধ্যে তুলনা করবো এবং দেখবো কোনটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হতে পারে। এই আর্টিকেলে কোকাকোলা ও মোজোর পরিচয়, দুইটার গুণগত মান, কোকাকোলা না মোজো - কোনটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং সাম্প্রতিক আলোচিত কোক বয়কটের পরিস্থিতিতে কোনটার কী হাল তা বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

কোকাকোলা ও মোজোর পরিচয়

কোকাকোলার পরিচয়:

১৮৮৬ সালে জন পেম্বারটন নামে একজন ফার্মাসিস্ট কোকাকোলা আবিষ্কার করে। শুরুতে এর নাম পেম্বারটনের ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোলা থাকলেও পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় কোকাকোলা, সংক্ষেপে কোক। এটি “দ্য কোকাকোলা কোম্পানি” কর্তৃক উৎপাদন এবং বাজারজাত করা হয়। বিশ্বের ২০০ টিরও বেশি দেশে এটি বাজারজাত করা হয়। মূলত আমেরিকান কোম্পানি হলেও পরবর্তীতে এটিকে ইসরায়েলের পণ্য হিসেবে প্রকাশ এবং প্রচার করা হয়।

বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় কোমল পানীয়গুলোর মধ্যে একটি। এমনকি বিশ্বের যত কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ড রয়েছে, সবগুলোর মধ্যে কোকাকোলা সবচেয়ে ব্যবসাসফল ব্র্যান্ড।

বিশ্বে ২০০ কোটিরও বেশি মানুষ কোককে নিজেদের পছন্দের কোমল পানীয় হিসেবে পান করে। ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, কোকাকোলা বিশ্বের সবচেয়ে দামী ব্র্যান্ডের তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থান পেয়েছিল।

কোকাকোলা একটি কার্বোনেটেড ড্রিংক বা পানীয় যা সাধারণত ক্যারামেল রঙের হয়ে থাকে এবং এতে ক্যাফেইন থাকে। এর প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বনেটেড ওয়াটার (পানি), উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ বা চিনি, ক্যাফেইন, ফসফরিক অ্যাসিড, ক্যারামেল রং, এবং নিজস্ব ইউনিক স্বাদ।

মোজোর পরিচয়:

মোজো বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ফলের স্বাদের কার্বোনেটেড ড্রিংক। এটি আকিজ গ্রুপের একটি পণ্য যা “আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড” -এর মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়।

বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মোজো বিশেষভাবে জনপ্রিয়। তাই তো মোজোর ট্যাগলাইন ব্যবহার করা হয় “অন্তরে তারুণ্য”। মোজো বিভিন্ন ফ্লেভারে পাওয়া যায়, তবে লেবুর স্বাদের ফ্লেভারটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।

মোজোর উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বনেটেড ওয়াটার, চিনি, সাইট্রিক অ্যাসিড, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম স্বাদ, এবং প্রিজারভেটিভস। মোজো ক্যাফেইন মুক্ত একটি পানীয়, যা কোকাকোলার তুলনায় কিছুটা হলেও স্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়। কারণ এতে ফলের নির্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

কোকাকোলা না মোজো - দুটির মধ্যে তুলনা 

দুইটিই কোমল পানীয়, তাই খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে উপাদান এবং অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য একটি অন্যটির চেয়ে আলাদা। চলুন কোকাকোলা না মোজো- কোনটির কী পার্থক্য আছে তা জেনে নেওয়া যাক।

উপাদানগত তুলনা:

কোকাকোলার প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বনেটেড ওয়াটার, অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজযুক্ত কর্ন সিরাপ বা চিনি, ক্যাফেইন, ফসফরিক অ্যাসিড, ক্যারামেল রং।

অন্যদিকে, মোজোর উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বনেটেড ওয়াটার, চিনি, সাইট্রিক অ্যাসিড, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম স্বাদ, এবং প্রিজারভেটিভস।

মোজোতে ক্যাফেইন নেই, যা কোকাকোলার তুলনায় একটি সুবিধা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ক্যাফেইন অতিরিক্ত সেবনে উদ্বেগ, অনিদ্রা, এবং হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। কিডনির জন্যও খারাপ হতে পারে বলে কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে।

সুতরাং, উপাদানগত পার্থক্যে কোকাকোলার তুলনায় মোজো ভালো।

চিনি:

কোমল পানীয়গুলোর মধ্যে চিনি একটি সাধারণ উপাদান। চিনি ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে সম্পর্কিত।

ডায়েট কোক কতটা উপকারী 

কোকাকোলা এবং মোজো- উভয়েই চিনি থাকে, তবে উচ্চ মাত্রার ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ ব্যবহারের কারণে কোকাকোলার চিনি মোজোর তুলনায় বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। উচ্চ মাত্রার ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ শরীরের জন্য আরও ক্ষতিকর কারণ এটি দ্রুত রক্তে শোষিত হয় এবং রক্তের গ্লুকোজ স্তর দ্রুত বাড়ায়, যা ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

অতিরিক্ত ক্যালরি:

কোমল পানীয়গুলো সাধারণত উচ্চ ক্যালরি যুক্ত হয় যা অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। কোকাকোলা এবং মোজো উভয়েই উচ্চ ক্যালরি যুক্ত, তাই নিয়মিত পান করলে ওজন বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ে। অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের ফলে শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট জমে যা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

অ্যাসিডিটি:

কোকাকোলায় থাকা ফসফরিক অ্যাসিড অতিরিক্ত গ্রহণে শরীরের ক্যালসিয়াম শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যা হাড়ের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অন্যদিকে, মোজোতে সাধারণত সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে যা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর।

স্বাদ এবং ব্যবহারের অভিজ্ঞতা

স্বাদের দিক থেকে কোকাকোলা এবং মোজো উভয়েই তাদের নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোকাকোলার একটি শক্তিশালী, ক্লাসিক স্বাদ রয়েছে যা অনেকেই পছন্দ করে। আর মোজোতে  ফলের স্বাদ থাকে যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। কিছু মানুষ মোজোর হালকা এবং তাজা স্বাদকে প্রাধান্য দেয়, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে।

তবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার দিক থেকে কোকাকোলা হাজার গুণে এগিয়ে আছে।

বিকল্প ব্যবহার

কোকাকোলা এবং মোজো উভয়কেই বিভিন্ন ককটেল এবং কুলার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোকাকোলা এর বহুমুখী স্বাদের কারণে অনেকেরই প্রিয়। কোকাকোলা অন্যান্য ড্রিংকস-এর সাথে মিশিয়ে পান করা যায়।

মোজোও বিভিন্ন ড্রিংকস-এর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এটি প্রধানত সরাসরি পানীয় হিসেবে বেশি জনপ্রিয়।

কোকাকোলা না মোজো - কোনটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

উপরে পানীয় দুটির বিষয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে তাতে হয়তো নিশ্চয় আপনারা বুঝতে পেরেছেন কোনটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী আর কোনটি উপকারী নয়।

উচ্চ মাত্রার ফ্রুক্টোজযুক্ত কর্ন সিরাপ, ফসফরিক অ্যাসিড ও ক্যাফেইনের জন্য কোকাকোলা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এককথায় উপাদানগত কারণে কোকাকোলার চেয়ে মোজো ভালো।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, যেহেতু দুটোই কোমল পানীয় এবং কোমল পানীয়তে উচ্চ ক্যালরি থাকে, তাই এগুলো যত কম পান করা যায় ততই উপকারী।

সাম্প্রতিক বয়কটের প্রেক্ষাপট

সম্প্রতি, বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে কোকাকোলার বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়েছে এবং এর ফলে অনেক মানুষ কোকাকোলা কেনা থেকে বিরত থাকছে বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন। এই বয়কটের কারণে কয়েকটি দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে কোকাকোলার বিক্রয় কমে গেছে এবং এটি কোম্পানির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোকাকোলা বয়কটের সময়ে মোজোর পরিস্থিতি

সম্প্রতি কোকাকোলা বয়কটের কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন স্থানে কোকাকোলার বিক্রয় ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে মোজোর মতো স্থানীয় পানীয়গুলো আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মোজো যখন ঘোষণা দেয় যে, প্রতি বোতল মোজো থেকে ১ টাকা করে ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষের জন্য অনুদান দেওয়া হবে, তখন থেকেই মোজো বাজারে জনপ্রিয়তার পরিমাণ বেড়ে যায়। মানুষ কোকাকোলার পরিবর্তে মোজো কিনতে শুরু করেছে, কারণ এটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং অনেকেই এটিকে স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে মনে করে। স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য কেনা সাধারণত স্থানীয় অর্থনীতিকে সমর্থন করে।

উপসংহার:

স্বাস্থ্যের দিক থেকে বিচার করলে, কোকাকোলা এবং মোজো উভয়েই উচ্চ চিনি এবং ক্যালরি যুক্ত, যা অতিরিক্ত সেবনে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে, মোজোর একটি বড় সুবিধা হলো এতে ক্যাফেইন নেই, যা কোকাকোলার তুলনায় কিছুটা হলেও স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এছাড়াও, মোজোতে ব্যবহৃত সাইট্রিক অ্যাসিড তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যেকোনো কোমল পানীয় নিয়মিত এবং অল্প পরিমাণে পান করা উচিত।

সবশেষে, স্থানীয় উৎপাদিত পানীয়গুলো কেনা মানে স্থানীয় অর্থনীতিকে সমর্থন করা হয়।

আপনি কোকাকোলা না মোজো - কোনটি খাবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।  তবে স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই যেকোনো কোমল পানীয় পান করা উচিত এবং অতিরিক্ত পান করা মোটেই ঠিক হবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম