এইতো শীতকাল চলে এসেছে। এ সময়ে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, মলিন হয়ে যাওয়া সমস্যা যেন লেগেই থাকে সঠিক যত্নের অভাবে। শীতকালে পরিবেশের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সাথে সাথে বাতাসের আর্দ্রতাও কমে যায়, যা ত্বকের কোষের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। যার দরুন ত্বকে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে ত্বকের ক্ষতি হবে ভেবে কোনো কেমিক্যাল প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে চান না কিংবা পার্লার এড়িয়ে চলেন। তাদের জন্যই এই আর্টিকেল। চিন্তার কিছু নেই! আপনার হাতের কাছে রান্নাঘরের যে সকল উপাদান আছে তা দিয়েই এই শীতে ঘরোয়া উপায়ে শুষ্ক ত্বকের যত্ন নিতে পারবেন। তবে তা করতে হলে একটু ধৈর্য ও সময় নিয়ে শুরু করতে হবে।
ত্বক শুষ্ক হওয়ার কারণ
যত্ন নেওয়ার উপায় বলার আগে জানতে হবে কেন ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। সেই কারণগুলো খুঁজে বের করলেই এই সমস্যা সমাধান করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। বিভিন্ন কারণে ত্বকে রুক্ষতা আসে। আবার কারও কারও প্রাকৃতিকভাবেই শুষ্ক ত্বক।
চলুন জেনে নিই কেন ত্বক শুষ্ক হয়।
- দিনে ঘনঘন গোসল করা।
- অতিরিক্ত ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বসবাস করা।
- অতিরিক্ত তাপ।
- পানিশূন্যতা।
- শুষ্ক আবহাওয়া।
- বারবার হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধোয়া।
- অতি ক্ষারীয় সাবান ব্যবহার।
- গরম পানি দিয়ে গোসল করা।
- শারীরিক কোনো অসুস্থতা।
- বয়স ৬০-এর বেশি হওয়া।
মূলত এই কারণগুলোই ত্বককে শুষ্ক করে তুলে। বয়সজনিত কারণটি ছাড়া অন্য কারণগুলো মানুষের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অর্থাৎ মানুষ চাইলেই তাদের ত্বক সতেজ, মসৃণ ও কোমল রাখতে পারে। এসব সমাধানের পাশাপাশি ত্বকের পর্যাপ্ত যত্ন নিলে শীতে রুক্ষতার হাত থেকে আপনার ত্বককে রক্ষা করতে পারেন।
এখন তাহলে জেনে নেয়া যাক কীভাবে ঘরোয়া উপায়ে শুষ্ক ত্বকের যত্ন করা যায়।
শীতে শুষ্ক ত্বকের যত্নে ঘরোয়া উপায়
নিয়ম করে সকাল ও রাতে ছোটখাটো বিষয়ে যত্নশীল হলেই আপনার ত্বক থাকবে সতেজ, কোমল ও প্রাণবন্ত। এখানে কিছু টিপস্ দেওয়া হলো যেগুলো অনুসরণ করলে ত্বক নিয়ে আপনাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
১. ক্লিনজিং : ত্বকে দিনে ২ থেকে ৩ বার ক্লিনজিং করুন। ঠান্ডা কাঁচা দুধ কটন বলে ভিজিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখুন তারপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে আপনার শুষ্কতা অনেকাংশেই কমে যাবে।
২. ফেইস স্ক্রাব : খানিকটা চালের গুড়া, মধু, আর অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। মুখে ৪/৫ মিনিট পর্যন্ত সেটি ম্যাসাজ করুন। তারপর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। তবে শীতকালে বেশি স্ক্রাব ব্যবহার করা ঠিক না। তাই সপ্তাহের ২/৩ বার স্ক্রাব করলেই যথেষ্ট।
৩. প্রাকৃতিক বডি স্ক্রাব : এক চামচ কফি, দুই চামচ চিনি, পরিমাণ মতো মধু, আমন্ড অয়েল (এক চামচ), আর অল্প একটু এসেনশিয়াল অয়েল (যদি থাকে) মিশিয়ে একটা বডি স্ক্রাব তৈরি করে নিন, এসেনশিয়াল অয়েল ঘরে না থাকলে তা আপাতত না নিলেও চলবে। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন গোসলের সময় এই স্ক্রাবটা ব্যবহার করবেন। তারপর ভালো মশ্চারাইজার লাগাবেন সারা শরীরে।
৪. প্রাকৃতিক বডি লোশন : ত্বকের তারুণ্যতা আর টানটান অবস্থা বজায় রাখতে বডি লোশনের জুড়ি নেই। আর সেটা যদি হয় প্রাকৃতিক বডি লোশন, তাহলে তো কথাই নেই। যেমন : নারিকেল তেল, আমন্ড অয়েল, ও অ্যালোভেরা জেল ইত্যাদি। এগুলো খুবই ভালো লোশন হিসেবে কাজ করে।
৫. গোসলের আগে শরীরে তেল মালিশ : গোসলের আগে ১০-৩০ মিনিটের মত বডি অয়েল (শরীরে দেওয়ার তেল) দিয়ে শরীর ম্যাসাজ করুন। সেটা হতে পারে নারিকেল তেল, ক্যাস্টর অয়েল, অলিভ অয়েল ইত্যাদি। এতে আপনার ত্বকের হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতা, কোমলতা ফিরে আসবে। আর আপনার ত্বককে প্রাণবন্ত করে রাখবে।
৬. লিপ স্ক্রাব : একটি লেবু মাঝখান থেকে গোল করে কেটে দুই ভাগ করুন। এক ভাগ লেবুতে চিনি আর ২/১ ফোটা মধু মিশিয়ে ঠোঁটে গোল গোল করে ম্যাসাজ করুন। এতে আপনার ঠোঁটের মরা চামড়া উঠে যাবে এবং চামড়া মসৃণ হবে।
৭. সানস্ক্রিন ব্যবহার : শীতকালে সূর্য প্রায় দেখাই যায় না। কিন্তু এর বেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব কিন্তু থেকেই যায়। তাই সানস্ক্রিনকে অবহেলা করা যাবে না। অনেকক্ষণ বাইরে থাকার প্রয়োজন হলে অবশ্যই বাইরে যাওয়ার আগে সানস্ক্রিন লাগিয়ে নিবেন।
৮. অতিরিক্ত গরম পানিতে গোসল না করা :
অনেকেরই একটা অভ্যাস হলো শীতের দিনে গোসল না করা। কেউ কেউ গোসল করা লাগলে গরম পানি ছাড়া গোসল করতে চায় না। কিন্তু এমনটা করা উচিত নয়। শীতকালে সবসময় গরম পানি দিয়ে গোসল না করে হালকা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করা উচিত। খুব বেশি গরম পানিতে গোসল করলে ত্বকের আদ্রতা কমে যাবে আর ত্বক শুষ্কতার কবলে পড়বে।
৯. ত্বক উপযোগী খাবার : ত্বকের যত্নের পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতার জন্য কিছু খাবার খেতে হবে।
যেসব খাবার খাওয়া ত্বকের জন্য ভালো:
খেজুরের গুড়
খেজুরে থাকে ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ (আয়রন) ও খনিজ উপাদান, যা স্নায়ুর ক্রিয়া সক্রিয় রাখতে ও রক্ত উৎপাদনে সহায়তা করে । রক্ত উৎপাদন স্বাভাবিক হলে ত্বকের জন্য তা খুবই উপকারী। এছাড়াও ওজন কমাতে, ক্লান্তি দূর করতে, ও হজম শক্তি বৃদ্ধিতে খেজুরের কোনো তুলনা নেই।
বাদাম
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাদাম অনেক কার্যকরী, তাছাড়াও নিয়মিত বাদাম খেলে ত্বক কোমল এবং লাবণ্যময় হয়ে উঠবে । বাদামের তেল গায়ে মাখলেও ত্বকের পক্ষে উপকার হয়।
মৌসুমী ফল ও শাকসবজি
শীতকাল নানান রকম সবজি এবং ফলের মৌসুম। সবুজ হলুদ এবং কমলা রংয়ের শাকসবজি এবং ফলে থাকে ওমেগা থ্রি, ভিটামিন সি ও এন্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বককে সুন্দর এবং মসৃণ করতে সাহায্য করে আর আর্দ্রতা বজায় রাখে । সেই সাথে এসব উপাদান দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
মধু
শীতকালে মধু খেলে যেমন ঠান্ডা, সর্দি দূর হয়, তেমন ত্বকের লাবণ্যতা আর উজ্জ্বলতায় মধুর উপকারিতা অনেক। কারণ এতে আছে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট ও পটাশিয়াম যা রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, ত্বককে নানান সমস্যা থেকে দূরে রাখে।
পানি
পানির অভাবে ত্বকে শুষ্কতার সৃষ্টি হওয়া নতুন কিছু নয়। পানিশূন্যতা রোধ করতে শীতকালেও কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে। পানির পাশাপাশি অন্যান্য তরল খাবার যেমন- ফলের রস, স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। তবে কোমল পানীয় খাওয়া উচিত নয়।
যে কাজগুলো করবেন
১. প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে হাত, পা, মুখমণ্ডলে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন। ভেসলিন, পেট্রোলিয়াম জেলি, গ্লিসারিন লাগাবেন।
২. গোসলে গরম পানি ব্যবহার না করে কুসুম গরম অথবা স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করবেন।
৩. ফলমূল শাকসবজি নিয়মিত খাবেন।
৪. রাতে ঘুমানোর আগে ত্বকে ময়েশ্চারাইজিং করবেন।
৫. বেশি করে পানি পান করবেন।
৬. আপনার ত্বকের জন্য মানানসই ফেইস ওয়াশ সহ অন্যান্য কসমেটিকস ব্যবহার করবেন।
যে কাজগুলো করবেন না
১. ত্বকে অতিরিক্ত সাবান ব্যবহার করবেন না।
২. অ্যালকোহল যুক্ত রূপচর্চার সামগ্রী এড়িয়ে চলবেন।
৩. শীতের দিনে অনেকেরই আগুন তাপ দেওয়ার ও রোদ পোহানোর অভ্যাস আছে। এটা বাদ দিতে হবে। সকাল ও বিকেলের মৃদু রোদ গায়ে লাগাতে সমস্যা নেই। কিন্তু কড়া রোদে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
৪. ভারী মেকআপ বা রূপচর্চা করবেন না।
৫. আপনার ত্বকের জন্য উপযোগী নয় এমন কোনো কসমেটিকস ব্যবহার করবেন না।
এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখলেই শীতে ত্বককে নিরাপদ রাখা সম্ভব।
শেষ কথা
ত্বক মানুষের সৌন্দর্যের প্রকাশ করে। তাই ত্বকের যত্নে অবহেলা না করে শীতে শুষ্ক ত্বকের যত্নে মনোযোগী হওয়া সকলেরই উচিত। উপরিউক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে আপনার ত্বকের সতেজতা, কোমলতা ও সৌন্দর্য বজায় থাকবে।